
লাইফ ইন্সুরেন্স কি বৈধ?
প্রশ্নঃ- লাইফ ইন্সুরেন্স করা কি জায়েয আছে? আমি আমার স্বামীর পরামর্শ অনুযায়ী সন্ধানী লাইফ ইন্সুরেন্স এ টাকা জমা দেই। অতঃপর জানতে পারি লাইফ ইন্সুরেন্স করা হারাম। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চাই; যাতে আমি আমার স্বামী বা শশুরবাড়ির লোকদেরকে বুঝাতে পারি। আর এটি হারাম জানার পর আমার করণীয় কী? কুরআন সুন্নাহ এর আলোকে জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
উত্তরঃ- ইন্সুরেন্স সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে গেলে প্রথমে এভাবেই শুরু করি।
ইন্সুরেন্স (Insurance) এটা (Ensurance) শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে: নিশ্চয়তা প্রদান করা।
তাত্তিকভাবে ইন্সুরেন্স হলো “ভবিষ্যতে অনিশ্চিত কোন ক্ষতির বা দুর্ঘটনার বিপরীতে নির্দিষ্ট কিছু টাকা (প্রিমিয়াম) ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিশোধ করা”।
এক কথা, ইন্সুরেন্স এমন একটি আর্থিক লেনদেনের চুক্তি, যার ফলে ভবিষ্যতে কোন দুর্ঘটনা সংগঠিত হলে তার ক্ষতিপূরণ দেয়ার নিশ্চিয়তার ভিত্তিতে কিস্তিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টাকা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
ইসলামী দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স বৈধ না কি অবৈধ?
শরীয়তের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স সম্পূর্ণ নাজায়েয হারাম একটি লেনদেন। “আন্তর্জাতিক ফিকহ একাডেমি” সহ বিশ্বের সকল নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান এবং বেশিরভাগ মুফতিগণ এ সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন- সব ধরণের বিসনেস ইন্সুরেন্স নাজায়েয ও হারাম।
উলামায়ে কেরাম বীমা তথা ইন্সুরেন্স নাজায়েয ও হারাম হওয়ার একাধিক কারণ উল্লেখ করেছেন- আমি তার মধ্য থেকে কয়েকটি উল্লেখ করছি।
এক. ইসলামের দৃষ্টিতে বীমা বা ইন্সুরেন্সে প্রত্যক্ষভাবে সুদ পাওয়া যায়। যেহেতু এতে যে পরিমাণ অর্থ জমা দেয়া হয় তার বিনিময়ে তার চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণ করা হয়। আর শরীয়তের পরিভাষায় সরাসরি আর্থিক লেনদেনে কমবেশি মুনাফা চুক্তিকেই সুদ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা’আলা পরিস্কারভাবে সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন-
অর্থ- “আর আল্লাহ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয় অর্থাৎ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন।”
দুই. ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স এর মাঝে ধোঁকা ও ঝুঁকি বিদ্যমান রয়েছে। যেহেতু বীমাকারীর এ কথা নির্দিষ্টভাবে জানা নেই যে, সে কী পরিমাণ টাকা/অর্থ জমা দিবে আর কী পরিমাণ টাকা গ্রহণ করবে?
এমনও হতে পারে, বীমাকারী ইন্সুরেন্স করার কিছুদিনের মধ্যেই সে দুর্ঘটনায় পতিত হল। তখন ইন্সুরেন্স/বীমা প্রতিষ্ঠান তার চুক্তির শর্তানুযায়ী অনেক বড় অংকের অর্থ দিতে বাধ্য হবে।
আবার এমনও হতে পারে, সারাজীবন বীমাকারীর কোন দুর্ঘটানাই সংগঠিত হল না। এক্ষেত্রে ইন্সুরেন্সকারীকে সকল কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। অথচ ইন্সুরেন্সকারী জীবিত অবস্থায় এর থেকে কিছুই পাবে না; বরং ইন্সুরেন্সকারী মৃত্যুর পর তার ওয়ারিশগণ এর লাভ পাবে। হাদীসে এ ব্যাপারে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এসেছে-
অর্থ- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে (আরবে প্রচলিত এক বিশেষ ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি) ও প্রতারণামূলক লেনদেন থেকে নিষেধ করেছেন।
তিন. ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স এ জুয়া বিদ্যমান। কেননা ইন্সুরেন্সকারী কখন মারা যাবে, আর সে তখন কত টাকা পাবে তার কোনই নিশ্চয়তা নেই। আর শরীয়তের পরিভাষায় যে কোন অনিশ্চিত লেনদেনকেই জুয়া বলে।
আল্লাহ তা’আলা জুয়াকে শয়তানের কাজকর্ম বলে অবিহিত করেছেন এবং জুয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন-
অর্থ- হে মুমিনগণ, মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ শয়তানের কার্য বৈ কিছু নয়। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাকো, যেন তোমরা সফল হও।
চার. ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্সে যুলুম পাওয়া যায়। কেননা এই বীমাকারী প্রয়োজনবশত কিস্তি দিতে অপারগ হয়ে এটা বাতিল করতে চাইলে ইন্সুরেন্স প্রতিষ্ঠান তার সমূদয় অর্থ রেখে দেয়, যা সুস্পষ্টরূপে যুলুম ও অমানবিক। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
অর্থ- হে মুমিনগণ, তোমরা এক অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।
পাঁচ. ইসলামের দৃষ্টিতে ইন্সুরেন্স এখানে মানুষকে বিক্রয়লব্ধ পণ্য হিসেবে বিচার বিবেচনা করে। যেহেতু এখানে মানুষের মৃত্যু বা দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে চুক্তি সংগঠিত হয়। তাই মানুষকে এক ধরণের পণ্য হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। অথচ মানুষ সবচে সম্মান ও মর্যাদাসম্পন্ন এক জাতি, যা কোন ক্রমেই বিক্রয়যোগ্য হতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
অর্থ- নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে ¯’লে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।
এছাড়াও আরো অনেক অনেক কারণ আছে, যার জন্য উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতভাবে সকল ধরণের ইন্সুরেন্সকে নাজায়েয ও হারাম বলে ফতোয়া প্রদান করেছেন।
মূল কথা হল, মানুষের সকল রিযিকের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তা’আলার হাতে। এ কথার উপর সকল মুমিন মুসলিমের বিশ্বাস রাখা খুবই জরুরী। এর বিপরীতে লাইফ ইন্সুরেন্স এর দ্বারা মৃত্যুর পরবর্তীতে পরিবার খুব ভালোভাবে চলতে পারবে এই বিশ্বাস অন্তরে লালন পালন করে যাওয়া শুধু গুনাহ না বরং এটি শিরকেরও পর্যায়ভুক্ত। তাই এ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক।
অতএব সন্ধ্যানী লাইফ ইন্সুরেন্স এ আপনার টাকা জমা দেয়া কুরআন, সুন্নাহ এবং ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে হারাম হয়েছে। আপনার তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। আর যেহেতু আপনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন তাই আল্লাহ তা’আলার কাছে খালেস দিলে তওবাহ করে সাথে সাথে ইন্সুরেন্স এর কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিবেন। সম্ভব হলে তাৎক্ষনাতভাবে জমাকৃত টাকা তুলে নিবেন। একান্তভাবে তুলতে সক্ষম না হলে পরবর্তীতে ইন্সুরেন্স প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ টাকা প্রদান করলে শুধু নিজের জমাকৃত টাকা রেখে বাকি টাকা সওয়াবের নিয়ত ছাড়া গরীবদের মাঝে প্রদান করবেন।
আল্লাহ তা’আলা যাবতীয় সুদ থেকে মুক্ত থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
fatawa: 144501010001
markajunnahdah@gmail.com
Copyright 2023, All Rights Reserved