
প্রচলিত বন্ধক ও তার শরয়ী বিধান
প্রচলিত বন্ধক ও তার শরয়ী বিধান
৪৬. প্রশ্ন: প্রচলিত বন্ধক ও বন্ধকি বস্তু ব্যবহার কি শরীয়ত সম্মত?
উত্তর: বন্ধক শরীয়ত সম্মত; কিন্তু বন্ধকি বস্তু ব্যবহার শরীয়ত কর্তৃক নাজায়েয। বিষয়টি বিস্তারিত জানার জন্য নি¤েœ বর্ণনা করা হল:
বন্ধকের শরয়ী পদ্ধতি
বর্তমান সমাজে অহরহ জমি বন্ধক দেয়া হয়; বা নেয়া হয়। বন্ধক গ্রহীতা জমিটি নিয়ে সেখানে ফসল ইত্যাদি করে থাকেন। কিন্তু ইসলাম প্রচলিত বন্ধক পদ্ধতি সম্পর্কে কি বলে? কিংবা বন্ধকের নীতিমালা কি এ সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই। তাই আমরা এ সম্পর্কে কিছু শরয়ী বিধান জেনে নেই।
আল্লামা হাসকাফী রহ. বলেন-
বন্ধক এর শাব্দিক অর্থ: কোন কিছুকে বন্দী করণ বা আটককরণ।
বন্ধক এর পারিভাষিক অর্থ: কোন অর্থ সম্পদীয় জিনিসকে আটক রাখা তথা বন্দী করা, বন্ধকদাতা এমন অধিকার আটকে রাখেন; যা পরিশোধ করা যেতে পারে।
বন্ধক পদ্ধতি কুরআন হাদীস দ্বারা স্বীকৃত
আল্লাহ তা’আলা বলেন-
আর তোমরা সফরে থাকলে এবং কোন লেখক পাওয়া না গেলে বন্ধকী বস্তু হস্তগত করে রাখা উচিত। একে অন্যকে বিশ্বাস করলে যাকে বিশ্বাস করা হয় তার উচিত অন্যের প্রাপ্য পরিশোধ করা এবং স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করা।
হযরতে আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ইহুদির কাছ থেকে বাকিতে (নির্দিষ্ট সময়ে মূল্য পরিশোধের শর্তে) খাদ্য ক্রয় করেছেন, অতঃপর মূল্যের জামিন হিসেবে নিজ বর্মকে বন্ধক রেখেছেন।
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহ. বন্ধক পদ্ধতির বৈধতা সম্পর্কে বলেন-
বন্ধক পদ্ধতি কুরআনের সুরা বাকারা এর ২৮৩ নং আয়াত দ্বারা প্রমাণিত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নিজ বর্মকে বন্ধক রাখা দ্বারাও প্রমাণিত হয়। এবং এর বৈধতার উপর উলামায়ে কেরামের ইজমা তথা ঐক্যমতও রয়েছে।
সমাজে প্রচলিত বন্ধক পদ্ধতি ও শরয়ী হুকুম
জমি বন্ধকের প্রথম পদ্ধতি:
ক্স বন্ধকদাতা বন্ধক গ্রহীতার নিকট থেকে নির্ধারিত পরিমাণ টাকা গ্রহণ করে আর বন্ধকগ্রহীতা জমি ভোগ করতে থাকে। যখন বন্ধকদাতা টাকা ফিরিয়ে দেয় তখন জমি হস্তান্তর করে দেয়।
প্রশ্ন হল: উপরোক্ত পদ্ধতি সহীহ কি? আর সহীহ না হলে বিকল্প কোন বৈধ পদ্ধতি আছে কি?
উত্তরে প্রথমত বলতে হয়; জমি বন্ধকদাতা মূলত ঋণগ্রহীতা; আর জমি বন্ধকগ্রহীতা মূলত ঋণদাতা। আর ঋণদাতার জন্য বন্ধকী জমি ভোগ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ না জায়েয। কেননা এটা মূলত ঋণ প্রদান করে বিনিময়ে সুদ গ্রহণেরই একটি প্রকার। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
প্রত্যেক ঋণ অতিরিক্ত উপকার গ্রহণ করলে তা সুদ গ্রহণেরই একটি প্রকার।
আল্লামা হাসকাফী রহ. বলেন-
বন্ধককৃত জিনিস জমি দ্বারা কোনভাবেই উপকৃত হওয়া যাবে না। কোন প্রকার খেদমত গ্রহণ করা যাবে না। বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। পোশাক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ভাড়া দেয়া যাবে না। কিংবা আরিআত তথা ব্যবহারেরও অনুমতি দেয়া যাবে না। বন্ধকদাতা বা বন্ধকগ্রহীতা কেউ তা পারবে না।
এখন প্রশ্ন হল: বন্ধকদাতা বন্ধকগ্রহীতাকে বন্ধকী জমি ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করলে বন্ধকগ্রহীতার জন্য উক্ত জমি ব্যবহার করা শরীয়ত সম্মত হবে কি?
এর উত্তর হল: বন্ধকদাতা বন্ধকগ্রহীতাকে বন্ধকী জমি ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করলেও বন্ধকগ্রহীতার জন্য উক্ত জমি ব্যবহার করা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ না।
বন্ধকগ্রহীতার জন্য কোনভাবেই বন্ধকী জিনিস থেকে উপকৃত হওয়া বৈধ হবে না। যদিও তাকে বন্ধকদাতা অনুমতি প্রদান করে। কেননা সে তাকে সুদের বিষয়ে অনুমতি প্রদান করেছে। আর বন্ধকগ্রহীতা পরবর্তীতে পূর্ণ ঋণই উসুল করবে। অথচ বন্ধককৃত জিনিস থেকে সে ইতিপূর্বে উপকৃত হয়েছে; সুতরাং উপকৃত হওয়াটা অতিরিক্ত থেকে যাবে; আর এটাই সুদ; যা অনেক বড় গুণাহ।
অতএব প্রচলিত জমি বন্ধক পদ্ধতি তথা “বন্ধকদাতা বন্ধক গ্রহীতার নিকট থেকে নির্ধারিত পরিমাণ টাকা গ্রহণ করে আর বন্ধকগ্রহীতা জমি ভোগ করতে থাকে। যখন বন্ধকদাতা টাকা ফিরিয়ে দেয় তখন জমি হস্তান্তর করে দেয়।” এটি শরয়ী দৃষ্টিকোন থেকে অবৈধ ও গর্হিত কাজ।
জমি বন্ধকের দ্বিতীয় পদ্ধতি:
ক্স বন্ধকদাতা বন্ধক গ্রহীতার নিকট থেকে নির্ধারিত পরিমাণ টাকা গ্রহণ করে আর বন্ধকগ্রহীতা জমি ভোগ করতে থাকে। যখন বন্ধকদাতা টাকা ফিরিয়ে দেয় তখন বছর হিসাব করে বন্ধকগ্রহীতা নাম মাত্র কিছু টাকা কম নিয়ে জমি হস্তান্তর করে দেয়। যেমন কেউ ২০ শতক জমি বন্ধক নিল ৫০,০০০/- টাকায় এবং সে তিন বছর এ জমি ভোগ করল। তিন বছর পর টাকা ফিরিয়ে দেয়ার সময় ১০০০/- টাকা কম নিল।
এখন প্রশ্ন হল: এ পদ্ধতিটি শরীয়ত কর্তৃক বৈধ কি?
এর উত্তর হল: এ পদ্ধতি মূলত ঋণ প্রদান করে বন্ধকী জমি ভোগ করার একটি অবৈধ ছুতা। কারণ এ ক্ষেত্রে আলাদাভাবে ইজারা তথা ভাড়া চুক্তি করা হয় না; বরং জমি ভোগ করার শর্তেই ঋণ দেয়া হয় এবং ঋণের সুবিধা পাওয়ার কারণেই জমির মালিক নামমাত্র মূল্যে ভাড়া হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং এটিও নাজায়েয।
বন্ধকী জিনিসকে বন্ধকদাতা ভাড়া দিলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। …. আর ভাড়া প্রদানকারী বন্ধকগ্রহীতা হলে এবং ভাড়া প্রদানের নিমিত্তে নতুন করে আয়ত্বে নেন; অথবা কোন ব্যক্তি তাদের একজনের উপস্থিতিতে ও অন্য জনের অনুমতি সাপেক্ষে ভাড়া প্রদান করেন; তাহলে এমতাবস্থায় বন্ধকচুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। ভাড়া বাবদ প্রদত্ত টাকা বন্ধকদাতাই পাবে এবং ভাড়া গ্রহণকারীর জন্য উক্ত জিনিসে হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকবে না। এক্ষেত্রে বন্ধকগ্রহীতা নিজ ঋণকে উসূল করে নিবে। কেননা বন্ধক চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে।
বন্ধকগ্রহীতা বন্ধকদাতার অনুমতি সাপেক্ষে বন্ধকী জিনিসকে কোথাও ভাড়ায় প্রদান করলে প্রদত্ত ভাড়া বন্ধকদাতা পাবে এবং বন্ধকচুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে।
বন্ধকগ্রহীতা বন্ধকী জিনিসকে ভাড়ায় নিয়ে নিলে ভাড়া নেয়া বিশুদ্ধ হবে এবং বন্ধকচুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে।
অতএবং দ্বিতীয় পদ্ধতিতে বন্ধকী জিনিসকে ভাড়া হিসেবে তা গ্রহণ করলে বন্ধকচুক্তি থাকবে না; বরং তা বাতিল বলে গণ্য হবে। সুতরাং দ্বিতীয় পদ্ধতিও শরীয়ত কর্তৃক বৈধ নয়। বৈধ করার একটি নামমাত্র ছুতা যা গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব এ থেকেও বিরত থাকতে হবে।
প্রচলিত বন্ধকের বিকল্প বৈধ পদ্ধতি:
প্রথম বৈধ পদ্ধতি
ক্স প্রচলিত বন্ধকী লেনদেনকে বৈধভাবে করতে চাইলে শুরু থেকেই বন্ধকী চুক্তি করবে না। বরং তা লীজ বা ভাড়া চুক্তি করতে হবে। জমির মালিক জমি ভাড়া দিবে। তার যত টাকা প্রয়োজন সেজন্য যত বছর ভাড়া দিতে হয় একত্রে তত বছরের জন্য ভাড়া দিবে। যেমন ২০ শতক জমির বার্ষিক ভাড়া ৫০০০/- টাকা। জনাব ফারহান সাহেবের ৩০,০০০/- টাকার প্রয়োজন। তাই তিনি তার ২০ শতক জমি ৬ বছর এর জন্য ভাড়া দিবে। আর এ ক্ষেত্রে অগ্রিম ৩০,০০০/- টাকা নিয়ে নিবে। এক্ষেত্রে জমির ভাড়া স্থানীয় ভাড়ার ন্যয় হতে হবে। লক্ষণীয়: নামমাত্র ভাড়া হবে না। এরপর ভাড়ার মেয়াদ শেষ হলে জমি ফেরত দিবে। কিন্তু ভাড়াগ্রহিতা প্রদেয় কোন টাকা ফেরত পাবে না। তবে হ্যাঁ; সময়ের পূর্বে ফেরত দিলে সে কতদিন ভাড়ায় ছিল সে পরিমাণ ভাড়া কর্তন করে অবশিষ্ট টাকা ভাড়াটিয়া ফেরত পাবে।
দ্বিতীয় বৈধ পদ্ধতি
ক্স বাই বিল ওয়াফা: প্রথমে জমিকে প্রথম বৈঠকে বিক্রয় করা হবে। বৈঠক বাতিল করার পর বিক্রেতা ক্রেতাকে বলবে; যখন আমার কাছে টাকা হবে তখন আপনাকে উক্ত জমিটি বিক্রয় করতে হবে। আর সে ওয়াদাবদ্ধ হবে যে, সে পূণরায় তার নিকটই বিক্রয় করবে। এভাবে হলে উক্ত লেনদেন বৈধ হবে।
অতএব প্রচলিত বন্ধকী পদ্ধতি গ্রহণ করলে গুণাহ হবে। আর আমাদের এর থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। আমাদের বিশেষ প্রয়োজনে অর্থের প্রয়োজন হলে উপরোক্ত বৈধ দু’টি পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে।
fatawa: 1445202311230003
Copyright 2023, All Rights Reserved